[ad_1]
নাটোর: পৃথিবীর আদিকাল থেকে বিয়েতে দেনমোহর হিসেবে নগদ অর্থ কিংবা মূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার বিধান রয়েছে, যা নারীর আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়াসহ পুরুষের একচ্ছত্র তালাকের অধিকারকে প্রশমন করে। আর দেনমোহর নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট দুই রকমই দেওয়া যায়।
যেটা স্ত্রী দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে তা দিয়ে দিতে হবে।
আর তাই বিয়েতে নগদ অর্থ-গহনা কিংবা মূল্যবান সামগ্রী নয়, দেনমোহর হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে পাঁচটি ফলদ ও বনজ গাছ চেয়েছেন নাটোরের সুকৃতি আদিত্য নামে এক কনে। পাত্রীর চাহিদা অনুযায়ী বর নাবিন আদনান দেনমোহর হিসেবে পরিবেশের উপকারী বন্ধু গাছ দিয়ে সম্পর্কের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছেন।
এমন ব্যতিক্রমী দেনমোহরের কারণে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় আলোচিত হয়েছেন সুকৃতি-নাবিন নবদম্পতি। বিয়ের দিন তারা গাছ লাগিয়ে বলেছেন, দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা দূর করে ভালোবাসাটাকে প্রাধান্য দিতেই গাছ নিয়ে তাদের এমন আয়োজন।
সম্প্রতি নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়ায় ঐতিহাসিক উত্তরা গণভবনের পাশে এমন বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর-কনের মধ্যে পূর্ব পরিচয় থাকলেও দুই পরিবারের সম্মতিতে ঘরোয়া পরিবেশেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। আর এই বিয়ের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেনমোহর হিসেবে পরিবেশবান্ধব গাছ। দেনমোহর হিসেবে আপাতত বরের কাছ থেকে পাঁচটি ফলদ ও বনজ গাছ নেন কনে সুকৃতি। এমন ব্যতিক্রম বিয়েতে প্রশংসায় ভাসছে এই নবদম্পতি।
কনে সুকৃতি আদিত্য নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া গ্রামের এম আসলাম লিটনের মেয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। আর নাবিন আনদান কুমিল্লার বাসিন্দা। তিনি একই অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। নাবিন এখন ঢাকায় শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন। প্রায় ছয় বছর আগে তারা পূর্বপরিচয় থেকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।
যথারীতি বিয়ে বাড়িতে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে পারিবারিকভাবে ধুমধাম করেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের আসরেই মোহরানা হিসেবে পাঁচটি ফলদ ও বনজ গাছ হস্তান্তর করেন বরপক্ষ। টাকার অঙ্কের হিসাবে না মিলিয়ে কনে সুকৃতির এমন চিন্তা চেতনায় সবাই আনন্দিত। তারা বিয়ের দিনেই গাছের চারা রোপণ করেছেন। বিয়ের পর এখন তারা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) সকালে বিয়ের দেনমোহর নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। এ নিয়ে এলাকাজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। বর-কনেকে দেখতে কনের বাবার বাড়িতে ভিড় জমাতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয় আলোচনা এবং নব দম্পতিকে শুভেচ্ছা জানায় শুভাকাঙ্ক্ষীসহ অনেকে।
কনে সুকৃতি আদিত্য বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সময়ে বিয়ের দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে বেড়িয়ে আসার প্রবণতা সৃষ্টি করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি নিজে এবং তার বাবা-মায়ের গাছ-পরিবেশের প্রতি রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে তিনজনের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার বিয়ের মোহরানা হিসেবে বেছে নেন গাছ।
তিনি বলেন, বিয়ে মানেই আর্থিক লেনদেনটা মুখ্য বিষয় না। দু’টি মানুষের মনের মিল হওয়াটাই বড় বিষয়। সেখান থেকেই তার মনে হয়েছে- যদি এমন কিছু করা যায়, যা প্রাকৃতিক-পরিবেশ ও আমাদের সম্পর্কটা সুস্থ রাখবে। সেই চিন্তা-চেতনা থেকে নতুন জীবন শুরু করার আগে আমার মনে হয়েছে, গাছ একটা দারুণ উপকরণ হতে পারে। এর মাধ্যমে পরিবেশটাও সুস্থ থাকল এবং পরিবেশের সুস্থতা দেখে আমরাও খুশি থাকলাম।
বর নাবিন আদনান বাংলানিউজকে বলেন, দেনমোহরের বিষয়বস্তুটা হচ্ছে নিরাপত্তা। তার কাছে মনে হয়েছে যে নিজেদের নিরাপত্তার চেয়ে পরিবেশের নিরাপত্তা বেশি জরুরি। এটা একটা প্রতীকী বিষয়। এর বাইরে বিশেষ কিছু নয়।
তিনি বলেন, প্রতীকী বিষয় হিসেবেই আমরা চর্চা করলাম যাতে- আমরা পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি। সুকৃতির ভিন্ন চিন্তাকে স্যালুট জানাই। পাশাপাশি তার প্রতি আমি খুবই খুশি। আমাদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন যেন সারা জীবন অটুট থাকে।
কনের বাবা এম. আসলাম লিটন বাংলানিউজকে বলেন, তার মেয়ে সুকৃতি আদিত্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার বিয়েতে মোহরানা নেবে না। নিলেও সে একটা টোকেন নিতে চায়। অভিভাবক হিসেবে তারা সুকৃতির সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মেয়ে মনে করে, মোহরানা নিয়ে টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সেই প্রতিযোগিতায় সুকৃতি থাকবে না। সমাজকে সে একটা বার্তা দিতে চায় যে, মোহরানাটা মূল নয়। মূলটা হচ্ছে দু’টি মানুষের বন্ধন। দু’টি মানুষের হৃদয় মন এক হয় বিয়ের মধ্য দিয়ে। এই বন্ধনটাই আসল।
তিনি বলেন, কোনো অর্থনৈতিক বা সম্পদের জায়গায় গিয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার চাইতে আত্মার সঙ্গে চুক্তি হওয়াটা বেশি জরুরি। সেই জায়গাটা সুকৃতি অনুভব করেছে। বাবা হিসাবে তিনি গর্বিত যে, তার মেয়ে এমন ব্যতিক্রম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ঘটনায় প্রথমে বরযাত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেও পরে সবাই প্রশংসায় ভাসিয়েছেন নব দম্পতিকে। জীবনের প্রথম এমন বিয়ে দেখে রীতিমতো হতবাক তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা গুলজান বেগম জানান, তিনি তার জীবনে এমন ব্যতিক্রম বিয়ে দেখেননি। বিয়ে বাড়িতে এসে বর কনের গাছ লাগানো দেখে তার খুবই ভালো লেগেছে। নতুন দম্পতি সুখে শান্তিতে থাকুক এমন শুভকামনা জানান তিনি।
সৈয়দ মাসুম রেজা নামে এক সাংস্কৃতিকর্মী বলেন, দেনমোহরে সব সময় কনেদের বা কনেপক্ষকে টাকার অঙ্ক বাড়াতে দেখেছি। কিন্তু সুকৃতির বিয়েতে ব্যতিক্রম দেখলাম। তার চিন্তা চেতনা অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য।
এদিকে ধর্মীয় বিধান মতে জানা যায়, দেনমোহর বলতে মুসলিম বিয়েতে স্বামীর কাছ থেকে বাধ্যতামূলক প্রাপ্ত অর্থ কিংবা মূল্যবান সামগ্রীকে বোঝায়, যা স্ত্রীকে সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ এবং বিয়ের প্রতিদান হিসেবে দেওয়া হয়। মুসলিম বিয়েকে দেওয়ানি চুক্তি বলা হয়, যেখানে প্রতিদান হিসেবে থাকে নির্দিষ্ট মোহরানা।
মুসলিম আইন অনুযায়ী মুসলিম বিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হয়, তার মধ্যে দেনমোহর আদায় করা অন্যতম। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুযায়ী, ‘দেনমোহরের অর্থ তলব করা মাত্রই তা স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুসারে, ‘এই আইনের বিধৃত কোনো কিছু মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহিতা কোনো স্ত্রীলোকের প্রাপ্য মোহর বা তাহার কোনো অংশের অধিকারী তাহার বিবাহবিচ্ছেদের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। ’
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০২৩
এসআইএ
[ad_2]
Source link